চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার

সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন
যুগে যুগে, দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধের পরিণাম আজ আর কারো অজানা নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন আজো মানুষের স্মৃতিতে অম্লান। ধ্বংসলীলা, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, যুদ্ধ বন্দিদের প্রতি অমানবিক আচরণÑ এসব হচ্ছে আধুনিক যুদ্ধের অনভিপ্রেত ফল। কিন্তু মানব ইতিহাসে এমন কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে যেগুলো আজকের প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বিধ্বংসী মারণাস্ত্র¿ প্রয়োগের মতো ছিল না। ছিল না নারী হত্যা, শিশু হত্যার মতো অমানবিক ঘটনায় পূর্ণ। ছিল ন্যায় ও ইনসাফকে পৃথিবীর জমিনে সুপ্রতিষ্ঠার মহান ব্রত। দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান শুক্রবার সংঘটিত বদর যুদ্ধ সেগুলোরই সূচনা ও আদর্শ। ভৌগোলিক ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, মদিনা থেকে প্রায় ৬০ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত একটি বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম বদর যেখানে তাওহীদ ও শেরেকের সংঘাত হয়েছিল ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ। বদর যুদ্ধের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার সুমহান যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ জন্য একে কোরআনুল করীমে ‘ইয়াউমুল ফোরকান’ নামে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়েছে। ইসলামকে পৃথিবীর জমিনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মহানবী (স.) ও তাঁর সাহাবীরা যত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তার কোনটিই আক্রমণাত্মক ছিল না, ছিল আত্ম রক্ষামূলক। রাসূল (স.)-এর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল ধ্বংসলীলা কমানো, ভয়াবহতা কমানো। কিন্তু রাসূল (স.) ও সাহাবীদের সেসব কল্যাণের প্রয়াস কাফের মুশরিকরা নস্যাৎ করে দিয়েছিল। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ টম এন্ডারসন তার লাইফ অব মোহাম্মদ গ্রন্থে লিখেছেন ‘অপরিসীম সাহস ও বীরত্বের অধিকারী মুহাম্মদ (স.) শত্রুপক্ষের মোকাবেলায় সমরবিদ্যার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। তিনি মক্কাবাসী কাফের মুশরিকদের বিশৃঙ্খল ও এলোপাতাড়ি যুদ্ধের মোকাবেলায় চমৎকার দূরদর্শিতা ও কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন।
সহীহ রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়, রাসূল (স.) মাত্র একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে মোকাবেলা করার অনুপাতে প্রস্তুতি নিয়ে ১২ রমজান শনিবার মদিনা তায়্যিবা থেকে রওনা হন এবং কয়েক মঞ্জিল অতিক্রম করেই বদর প্রান্তে পৌঁছান। বদরের সন্নিকটে বি’রে সুকইয়া নামক স্থানে পৌঁছে মহানবী যখন কায়েস ইবনে সা’দা (রা.)কে সৈন্য গণনার নির্দেশ দিয়েছিলেন তখন দেখা গেল, মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ৩১৩, অশ্ব মাত্র ২টি এবং উট ছিল ৭০টি। অপরদিকে কাফের মুশরিকদের ছিল এক হাজার জওয়ান, দুশ’ ঘোড়া, ছয়শ’ বর্মধারী এবং মনোরঞ্জনের জন্য সাথে ছিল গায়িকা ও বাদক দল। মুসলমানদের এ সংখ্যা স্বল্পতায় কাফের সম্প্রদায় অত্যন্ত গর্বিত হয় এবং মুসলমানদের দিকে সদম্ভ ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে। সে সময় রাসূল (স.) প্রার্থনা করেছিলেনÑ ‘হে আল্লাহ! আপনাকে মিথ্যা জ্ঞানকারী এ কোরাঈশরা গর্ব ও দম্ভ নিয়ে এগিয়ে আসছে। আপনি বিজয়ের যে প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছেন তা যথা শীঘ্রই পূরণ করুন।’
[তাফসিরে মাযহারী]। সংখ্যায় কম হলেও বদর যুদ্ধে লড়াই করার জন্য সাহাবীদের মনোবল ছিল পর্বতের মতো অটল। হযরত সেকদাদ (রা.) বলেছিলেনÑ ‘সে সত্তার কসম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যিনি আপনাকে সত্য ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন! আপনি যদি আমাদের আবিসিনিয়ার সেই ‘বাকুলাগিমাদ অঞ্চলে নিয়ে যান, তবুও আমরা জেহাদ করার জন্য আপনার সাথে যাবো।’ সা’দ ইবনে মোআজ (রা.) নামে আরেক সাহাবীর উক্তি ছিল এ রকম : সে সত্তার কসম! যিনি আপনাকে দ্বীনে হক দিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদিগকে সমুদ্রে নিয়ে যান, তবে আমরা আপনার সাথে তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়বো। সাহাবীদের কথা শুনে মহানবী (স.) অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং দু’হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে দোয়া করেন। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছ থেকেই শক্তি সঞ্চয় করি। তোমার নামেই আক্রমণ পরিচালনা করি এবং তোমার দ্বীনের জন্যই লড়াই করি। আমার জন্য আল্লাহতায়ালাই যথেষ্টÑ তিনি উত্তম অভিভাবক। বদর যুদ্ধে কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়, মুসলমানদের হিম্মত ও বীরত্বের কথা তাফসিরে মাযহারি, তাফসিরে রাহুল বয়ান, তাফসিরে কুরতুবিসহ অগণিত কিতাবের পাতায় লিপিবদ্ধ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।