Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বেপরোয়া ক্ষমতাধরদের পতন

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৯ এএম

বছর আসে বছর যায়। তবে প্রতি বছরই কিছু ঘটনা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এভাবেই আরেকটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। আর মাত্র কয়েক দিন পরই শেষ হচ্ছে ঘটনাবহুল ২০২০ সাল। এ বছর যেসব ঘটনা ঘটেছে; সেগুলোর মধ্যে কিছু ঘটনা চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিসের টেবিল, পাড়া-মহল্লা, সামাজিক যোগাযোগসহ সর্বমহলে আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের মধ্যে বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ক্ষমতাধর বেশ কয়েকজনের পতনসহ নানা ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী ২০২০ সাল। এসকল কাজে ব্যাপক প্রশংসাও অর্জন করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
তাদের মধ্যে রয়েছেন- রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনু, তার ভাই একই কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়া, যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী, রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম, জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফ চৌধুরী, তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী, স্বর্ণ ও গাড়ি ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন মনির, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিমের ছেলে মোহাম্মদ ইরফান সেলিম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক, সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী শারমিন জাহান প্রমুখ।
ক্যাসিনো হোতা এনু-রূপন গ্রেফতার : বছরের শুরুতেই ১৩ জানুয়ারি পৃথক অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনো কারবারি রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনু এবং তার ভাই একই কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে ২৪ ফেব্রæয়ারি তাদের বাসার পাঁচটি সিন্দুক বা ভল্ট থেকে সাড়ে ২৬ কোটি টাকা উদ্ধার করে র‌্যাব। এর আগে ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এনামুল হক এবং তার ভাই রূপন ভূঁইয়ার পুরান ঢাকা ৩১ নম্বর বানিয়ানগর বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে পাঁচ কোটি টাকা এবং ৭৩০ ভরি সোনা উদ্ধার করে র‌্যাব। এর পর ২৩ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে গেন্ডারিয়া থানায় দুটি আলাদা মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একাধিক বার অভিযান চালিয়েও তাদের গ্রেফতার করা যায়নি। অবশেষে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ধরা পড়লেন আলোচিত এ দুই ভাই।
যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়া গ্রেফতার : গত ২২ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাল টাকা বহন ও অবৈধ টাকা পাচারের অভিযোগে যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরীসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি পাপিয়ার ইন্দিরা রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, ৫ বোতল বিদেশি মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক, বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অস্ত্র মামলা ছাড়া বাকি মামলাগুলো হলো শের-ই-বাংলা নগর থানার মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা, গুলশান থানায় মানি লন্ডারিংয়ের মামলা, বিমানবন্দর থানার বিশেষ ক্ষমতা আইনে (জাল টাকার) মামলা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা মামলা।
ডা. সাবরিনা গ্রেফতার : গত ২৩ জুন করোনার ভুয়া সনদ দেওয়া, জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফ চৌধুরীসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। জানা যায়, জেকেজির কর্ণধার আরিফ ও তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী মিলে করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ বিক্রি করেছেন। প্রতিটি টেস্টের জন্য জনপ্রতি নিয়েছেন সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। আর বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি তারা নিতেন ১০০ ডলার। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১২ জুলাই ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকেও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেফতার করে পুলিশ।
রিজেন্ট সাহেদ গ্রেফতার : গত ৬ জুলাই র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। পরীক্ষা ছাড়াই করোনার সনদ দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আসছিল তারা। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অন্তত ছয় হাজার ভুয়া করোনা পরীক্ষার সনদ পাওয়ার প্রমাণ পায়। একদিন পর গত ৭ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে র‌্যাব রিজেন্ট হাসপাতাল ও তার মূল কার্যালয় সিলগালা করে দেয়। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ওই দিনই উত্তরা পশ্চিম থানায় নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়। এরপর থেকে সাহেদ পলাতক ছিলেন। পরে ১৪ জুলাই গাজীপুরের কাপাসিয়ার একটি বাড়ি থেকে রিজেন্ট গ্রুপ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের প্রতারণা কাজের অন্যতম সহযোগী এবং এই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৫ জুলাই মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ওই দিন ভোর সাড়ে ৫টায় সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত থেকে অবৈধ অস্ত্রসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে সেখান থেকে তাকে ঢাকায় আনার জন্য র‌্যাবের একটি বিশেষ টিম সাতক্ষীরায় যায়। পরে ওই দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়।
গোল্ডেন মনির গ্রেফতার : গত ২০ নভেম্বর রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় স্বর্ণ ও গাড়ি ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন মনিরের বাসায় রাতভর অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে শেষে অবৈধ অস্ত্র ও মাদকসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার জব্দ করা হয়।
হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান গ্রেফতার : গত ২৫ অক্টোবর রাতে ধানমন্ডি এলাকায় ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ‘সংসদ সদস্য’ লেখা সরকারি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়। ওই রাতে এ ঘটনায় জিডি হলেও পরদিন ভোরে হাজী সেলিমের ছেলেসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ ঘটনায় গত ২৬ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিমের ছেলে মোহাম্মদ ইরফান সেলিমকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনাও দেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এরপর হাজী সেলিম ও তার ছেলের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হয়। বেরিয়ে আসে একের পর এক অপকর্ম। এক পর্যায়ে হাজী সেলিমও চলে যান আত্মগোপনে। কিন্তু কয়েকদিন পরে ফের পুরান ঢাকায় ফিরে আসেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক গ্রেফতার : রাজধানীর তুরাগে সাত তলার দুটি বিলাসবহুল বাড়িতে ২৪টি ফ্ল্যাট, একইস্থানে অন্তত ১২ কাঠার আরেকটি প্লট ছাড়াও হাতিরপুলে নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনের মালিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক। তৃতীয় শ্রেণির পদস্থ একজন গাড়িচালক হলেও ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো গাড়ি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনকে জিম্মি করে হস্তক্ষেপ করতেন ডাক্তারদের বদলি-পদন্নোতিতেও। তদবিরের নামে আদায় করে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। যার বদৌলতে অল্প দিনেই শত কোটি টাকারও বেশি অর্থ-সম্পদের মালিক বনে যান এই মালেক ড্রাইভার। শুধু তাই নয়, অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে চাকরি দিয়েছেন নিজের আত্মীয়-স্বজনকে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২০ সেপ্টেম্বর তুরাগের কামারপাড়া এলাকার একটি ৭তলা ভবন থেকে আবদুল মালেককে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এসময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ জাল বাংলাদেশি টাকা, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়।
সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী শারমিন জাহান গ্রেফতার :
গত ২৪ জুলাই রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী শারমিন জাহানকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নকল ‘এন৯৫’ মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের’ স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শারমিন জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজে স্নাতকোত্তর শারমিন ২০০২ সালে ছাত্রলীগের বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের গত কমিটিতে তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক ছিলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন