Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনার টিকা জানুয়ারিতে

টিকার দাম পড়বে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, বাহরাইনে প্রয়োগ শুরু

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

করোনাভাইরাসের মহামারি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই এর প্রতিষেধক টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দিনরাত কাজ করে নিরাপদ টিকা উদ্ভাবন করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এরই মধ্যে বেশ কিছু টিকা প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। যা নজিরিবিহীন এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের একটা আশাবাদ। তবে কিছু সম্ভাব্য টিকা মানুষের ওপর পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্তত তিনটি দেশে সাধারণ মানুষকে কোভিডের টিকা দেয়া শুরু হয়ে গেছে। মার্কিন ওষুধ কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেকের তৈরি করোনাভাইরাস টিকার অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।

গত সোমবার এই টিকার প্রথম প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে টিকার ডোজ পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি একই দিনে টরন্টো এবং কুইবেকে দুইজনকে টিকা দেয়ার মধ্য দিয়ে কানাডায় শুরু হয়েছে ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনা টিকার প্রয়োগ। এছাড়া গত রোববার চীনের ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রæপ ও সিনোফার্মের তৈরি টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে বাহরাইন। এদিকে রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, তারা এক মাসের মধ্যে করোনার টিকা আনার ব্যাপারে আশাবাদী। এর আগে গত ৭ ডিসেম্বর আমেরিকার ফাইজার এবং জার্মানির বায়োএনটেক সংস্থা মিলে যে উদ্ভাবন করা প্রতিষেধক ব্রিটেনের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োগ শুরু করে। ব্রিটেন এবং রাশিয়াতে টিকা দেয়া শুরু হবার পর বাংলাদেশে অনেকে বেশ আশাবাদী হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, জানুয়ারির শুরুতেই মিলবে করোনাভাইরাসের টিকা। ইতোমধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশের বেক্সিমকো এবং ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে।

সূত্র মতে, ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি করোনাভাইরাসের টিকাটি ভারতে উৎপাদনের দায়িত্ব পেয়েছে সিরাম ইন্সটিটিউট। গত বৃহস্পতিবার ভারতের সঙ্গে ঢাকায় একটি চুক্তিও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আমরা আশা করি সামনের মাসের প্রথম দিকেই আমরা টিকা পেয়ে যাবো। অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা আমরা ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে ব্যবস্থা করেছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, তিন কোটি ডোজ টিকা সরকার সরাসরি নিয়ে আসছে। এছাড়া জনসংখ্যার ২০ শতাংশকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টিকা দেবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে টিকা দেবে সেটার জন্য হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে। তিনি দাবি করেন, অনেক দেশ এখনো ‘টিকার ব্যবস্থা’ করতে পারেনি। সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক আগেই টিকার ব্যবস্থা করেছে। একই সঙ্গে জাহিদ মালেক বলেন, টিকা সংগ্রহের জন্য টাকার কোন সমস্যা হবে না। এজন্য বিশ্বব্যাংক সহায়তা করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে সারা বিশ্বে টিকা তৈরির নানা উদ্যোগ নিয়ে একটি খসড়া তালিকা রয়েছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত এ তালিকায় ১৬০টি উদ্যোগের তথ্য ছিল। তালিকার তথ্য অনুযায়ী, ২১ টিকা মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর ১৩৯টি প্রাক-পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়ে গেছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা ২১ টিকার মধ্যে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের একটি টিকা আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোন দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির জন্য নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি হলে এক্ষেত্রে ১২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে। কিন্তু সরকার অক্সফোর্ডের ৩ কোটি ভ্যাকসিন পেতে চুক্তি করেছে সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। অন্যদিকে কোভ্যাক্স সুবিধার মাধ্যমে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার টিকা পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। এই টিকাগুলো ডাবল ডোজ হওয়ায় ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে দেয়া সম্ভব হবে। অর্থাৎ বিভিন্ন উৎস থেকে যে পরিমান টিকা পাওয়া যাবে তাতে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মানুষকে এর আওতায় আনা সম্ভব হবে। বাকিরা থেকে যাবে টিকা সুবিধার বাইরে।

টিকা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই বা গ্যাভি-টিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট) কাজ করছে। আর যখনই টিকা আসুক না কেন, সারা পৃথিবীর মানুষ যেন একসঙ্গে পায় সে বিষয়ে গত ৪ জুন গ্লোবাল ভ্যাকসিন সামিট হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় ‘কোভ্যাক্স’ ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে পৃথিবীর সবাই যেন সমভাবে টিকা পায়।

কোভ্যাক্স সুবিধা থেকে বাংলাদেশের ৬৮ মিলিয়ন বা ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার টিকা পাবে। যে টিকাগুলো ডাবল ডোজের। অর্থাৎ জনপ্রতি দুই ডোজ টিকা দিতে হবে। মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ শতাংশ হারে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ এই টিকা পাবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মা, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক। তিনি বলেন, আগামী ২০২১ সালের মধ্যে এই টিকা পাওয়া যাবে। গত জুলাই মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ কোভ্যাক্সে আবেদন করে এবং গ্যাভি সেটি গ্রহণ করে গত ১৪ জুলাই। বাংলাদেশ গ্যাভির কাছ থেকে ৬৮ মিলিয়ন বা ছয় কোটি ৮০ লাখ টিকা পাবে (দুই ডোজ) ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য। সে হিসাবে ৩৪ মিলিয়ন বা তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য প্রথম ধাপে করোনার টিকা পাবে বাংলাদেশ। তবে এই টিকা পেতে বাংলাদেশকে কো ফিন্যান্সিং করতে হবে। এক্ষেত্রে এক দশমিক ছয় থেকে দুই ডলার দাম দিতে হতে পারে।

ডা. মো. শামসুল হক বলেন, সরকার ইতোমধ্যে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কিনতে পারবে চার ডলারের বিনিময়ে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পরিবহন খরচ সব মিলিয়ে এর সঙ্গে যোগ হবে আরও এক ডলার। সেখান থেকে বাংলাদেশ কিনবে ৩০ মিলিয়ন ডোজ। এজন্য ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগ থেকে প্রায় ৭৩৫ কোটি টাকা ছাড় করেছে। তবে এই টিকা অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রি কোয়ালিফাইড হতে হবে। এ দুটি টিকার সোর্স ছাড়াও চীনের সিনোভ্যাক, রাশিয়ার স্কটনিক, জিএসকে, সানোফি এবং ফাইজারের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানান ডা. শামসুল হক। তিনি জানান, সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে তিন কোটি টিকা পাবে। এর জন্য সরকারের ব্যয় হবে এক হাজার পাঁচশত উননব্বই কোটি তেতাল্লিশ লাখ টাকা।

এছাড়া কোল্ড চেইন ইকুইপমেন্ট, এডি সিরিঞ্জ, সেফটি বক্স কেনা, ভ্যাকসিন কেন্দ্র পর্যন্ত পরিবহন, জনবল, মাইক্রোপ্ল্যানিং ও তালিকা প্রণয়ন, সুপারভিশন ও মনিটরিং প্রশিক্ষণ, প্রচার-প্রচারণাসহ মানুষের শরীরে টিকা দেয়া পর্যন্ত প্রতি ডোজ টিকা আরও সোয়া ডলার ব্যয় হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তিন কোটি টিকার জন্য আরও তিন কোটি পঁচাত্তর ইউএস ডলার প্রয়োজন।

এদিকে ওষুধ কোম্পানিসহ বেসরকারি খাতের কর্মীদের মধ্যে বিতরণের জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ১০ লাখ ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা আনার কথা ভাবছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। জানা গেছে, বিজনেস সেক্টরের ফ্রন্ট লাইনার, বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্যাংক, অন্যান্য করপোরেট হাউজে যারা কাজ করছেন তাদের দিতে এই উদ্যোগ। প্রতি ডোজ টিকার জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটকে দিতে হবে ৮ ডলার। এর সঙ্গে আমদানি ব্যয় ও অন্যান্য খরচ মিলে প্রতি ডোজ টিকার দাম ১১০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এবিএম খারশীদ আলম বলেন, টিকার প্রাপ্যতা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে যে টিকা কেনা হচ্ছে সেটি প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে তারা সরবরাহ করবে। তাই চাইলেও সবাইকে একসঙ্গে টিকা দেয়া সম্ভব হবে না। তবে এসব বিষয়ে কাজ করতে ‘কোভিড ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করেছে সরকার। এছাড়াও ‘বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রিপ অব ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট’ কাজ করছে। রয়েছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রিপায়ের্ডনেস অ্যান্ড ডেপ্লয়মেন্ট কোর কমিটি।

জানা গেছে, চুক্তি অনুয়ায়ী ইন্ডয়ার সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে দেশে করোনাভাইরাসের টিকা আসবে তিন কোটি ডোজ। তবে এই টিকা একবারে আসবে না। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে ৬ মাসে এই পরিমান টিকা দেশে আসবে। এজন্য দেশবাপী করোনা টিকা কার্যক্রমও চলবে ছয় মাস ধরে।



 

Show all comments
  • আবদুল মান্নান ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৩৯ এএম says : 0
    আল্লাহ যেন সকলকে এই রোগ থেকে হেফাজত করেন
    Total Reply(0) Reply
  • নিয়ামুল ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:২০ এএম says : 0
    আল্লাহ হেফাজতের মালিক
    Total Reply(0) Reply
  • শফিকুল ইসলাম ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:৪৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশ এখন সিঙ্গাপুর কানাডা থেকেও ধনী আমরাও ফ্রী টিকা পাবো
    Total Reply(0) Reply
  • Khan A Sayem ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:৪৭ এএম says : 0
    দূর্লভ এক টিকা যা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে এর আগেই যেন মহান আল্লাহ সব ঠিক করে দেন আমিন।
    Total Reply(0) Reply
  • Saimon Islam ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:৪৮ এএম says : 0
    Alhamdulillah
    Total Reply(0) Reply
  • Foridul Islam ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ৬:৪৩ এএম says : 0
    দ্রুত যেন আমরা এ মহামারীর হাত থেকে রেহাই পাই। এ কামনা করি।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Zakaria ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১:৩২ এএম says : 0
    টিকার উপর নির্ভর না করে আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত। বাঁচানোর মালিক আল্লাহ পাক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ