Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘২০২১ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি’

এশিয়ান রিভিউকে শেখ হাসিনা

কূটনৈতিক সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১:০৫ পিএম | আপডেট : ২:৩৯ পিএম, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

দেশের চলমান দ্রুতগতির অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া আরও গতিশীল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই প্রক্রিয়া চলমান থেকে আগামী তিন বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে পৌঁছে যাবে বলে মনে করছেন তিনি।

চলমান সরকারের মেয়াদ পূরণ ও আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে দেওয়া একান্ত এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, আগামী ২০২৪ সাল থেকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হবে।

নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ বলছে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ ধরে রেখে গত একদশক ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশের উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। গত জুনে শেষ হওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই হার ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে পৌঁছে যায়। শেখ হাসিনা আশা করছেন, চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে এবং এই হার বাড়তেই থাকবে। তিনি বলেন, আমরা এমন সব কর্মসূচি গ্রহণ করেছি যে, আবার নির্বাচিত হয়ে আসতে পারলে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।

নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এশিয়ার দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। এর পেছনে কাজ করেছে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতিমালা। এর মধ্যে তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদাহরণ দেন। বর্তমানে এই একশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১১টি অঞ্চল পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে এবং আরও ৭৯টি অঞ্চল স্থাপনের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।
নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ বলছে, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেখ হাসিনার জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। এর আগে, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা ধরে রাখলেও ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি। বর্তমানে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দন্ড পেয়ে কারাবন্দি থাকলেও দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও বিভিন্ন মতামত জরিপের ফলে উঠে এসেছে, ৩০০ আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পেয়ে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতা ধরে রাখতে যাচ্ছে।
এদিকে, দেশের চলমান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য বিদ্যুতের চাহিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারও বিদ্যুতের এই বাড়তি চাহিদা মোকাবিলার জন্য অব্যাহতভাবে পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে আগামী বছরই দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৭ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এর ৫৮ শতাংশই আসছে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। কিন্তু বিভিন্ন গ্যাস কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের হার কমছে। এ কারণেই জ্বালানির চাহিদা পূরণে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি ছাড়াও পারমাণবিক শক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের দিকে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ।

নিক্কেই এশিয়ান রিভিউয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারে তার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মকান্ডের উল্লেখ করে বলা হয়, ২০০৯ সালের শুরুতেই ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শেখ হাসিনা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে উচ্চাভিলাষী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। এই সময়ের মধ্যে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১২১টি। এছাড়া, তিনি ক্ষমতায় আসার আগে দেশের ৪৭ শতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছালেও তার দুই মেয়াদের শাসনামলের শেষ দিকে এসে এখন দেশের প্রায় ৯৩ শতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই দেশের শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে শেখ হাসিনার।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা করছে রাশিয়া ও ভারত। শেখ হাসিনা বলেন, দুইটি রিয়্যাক্টরের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। ২০২৪ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাবে।

দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এখনও উপযুক্ত স্থান খুঁজছি। সেক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হতে পারে বলে জানান তিনি। উপযুক্ত পাওয়া গেলে আসন্ন নির্বাচনের পর ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রস্তাব আহ্বান করা হবে।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, এরই মধ্যে দ্বিতীয় এই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা করতে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের আওতায় গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দেশটি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অংশীদার হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশে ৩ হাজার ৮শ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহায়তার আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে ২ হাজার ৪শ কোটি ডলার এবং যৌথ উদ্যোগের আওতায় আরও এক হাজার ২৬০ কোটি ডলার সহায়তার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ২৫ শতাংশ মালিকানার অংশীদার হয়েছে চীন। চীনের সামরিক অস্ত্রেরও অন্যতম বড় ক্রেতা বাংলাদেশ।

তবে ক্ষমতাধর দেশগুলোর সঙ্গে ‘সুসম্পর্কে’র ওপর জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ‘গ্রহণযোগ্য ও স্বস্তিকর’ প্রস্তাবকেই বিবেচনা করবে বাংলাদেশ, সেটা যে দেশেরই হোক না কেন।
গত বছর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সংখ্যালঘু প্রায় ৮ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয়দানের বিষয়টির নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি নাগরিক উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিলেন। তাদের আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই রোহিঙ্গা নাগরিকদের প্রতি বাংলাদেশ সহমর্মিতা দেখিয়ে তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি তখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা অনুধাবনের আহ্বান জানাই, জনগণ আমার সেই আহ্বানে আস্থা রেখেছে। এ বিষয়ে আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। আমি তাদের বলেছিলা, প্রয়োজন হলে আমরা আমাদের খাবার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাব। জনগণ আমার কথায় আস্থা রেখেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আমরা তাদের খাদ্যের সংস্থান করেছি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছি এবং তাদের নারী ও শিশুদের যত্ন নিয়েছি।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর থেকেই তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার কথাও চূড়ান্ত হয়েছিল। তবে প্রত্যাবাসনের জন্য নির্বাচিত রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এ অবস্থায় কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে সরকারের পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শেখ হাসিনা। তবে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে ভাসানচর রোহিঙ্গাদের জন্য কারাদ্বীপ হয়ে উঠবে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার উদ্বেগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, এটি চমৎকার একটি দ্বীপ। গৃহপালিত পশুপালনের জন্য স্থানীয় জনগণ এই দ্বীপ ব্যবহার করে থাকে। রোহিঙ্গারা বরং এই দ্বীপে আরও ভালোভাবে বাঁচতে পারবে। তাদের সন্তানেরা শিক্ষা পাবে, স্বাস্থ্যসেবা পাবে। আমরা এরই মধ্যে একটি ওয়্যারহাউজ তৈরি করেছি, যেন সেখান থেকে তাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিতে পারি। বর্তমানে আমরা এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আবাসনের ব্যবস্থা করছি। তবে সেখানে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব।
কোনো রোহিঙ্গাকেই বলপূর্বক মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে না বলে ফের নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সুরাহা করার জন্য অন্যান্য দেশ ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার কিভাবে তাদের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে পারে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন এ বিষয়ে সমাধানের পথ বের করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেখ হাসিনা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ